রিজার্ভ বাড়লেও নাজুক অবস্থায় দেশের ব্যাংকিং খাত
রিজার্ভ বাড়লেও নাজুক অবস্থায় দেশের ব্যাংকিং খাত
বর্তমান সরকারের পাঁচ বছরে ব্যাংকিং খাতে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। সরকারের মন্ত্রী, এমপি, উপদেষ্টা ও ধ্বজাধারী আমলাদের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটসহ নানামুখী অনিশ্চয়তার কারণে ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। তাই দিন দিন ব্যাংকে অলস অর্থের পরিমাণ বাড়ছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ বাড়লেও তা দেশের অর্থনীতির জন্য কোনো সুসংবাদ নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক হাজার ৭শ’ কোটি (১৭ বিলিয়ন) ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, বৈধ পথে প্রবাসীদের আয় ও রফতানি আয় বৃদ্ধি এবং আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণের কারণেই রিজার্ভ ক্রমাগত বাড়ছে।
তবে রিজার্ভ বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতির জন্য তেমন কোনো সুসংবাদ নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিন বলেন, বাজারে হস্তক্ষেপ করে ডলার কিনে রিজার্ভ বাড়িয়ে সঠিক কাজ করছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বড় অংকের রিজার্ভ ধরে রেখে কোনো লাভ নেই। একে যে করেই হোক বিনিয়োগে নিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, মানুষ না খেয়ে যাতে না মরে—সে পরিমাণ খাদ্য আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় রিজার্ভ জমা থাকলেই যথেষ্ট। কিন্তু বাম্পার ফলনের কারণে আমাদের গুদামগুলোতে ১৫ লাখ টনের বেশি খাদ্য মজুত আছে। আগামী এক-দেড় বছরে কোনো খাদ্য আমদানি করতে হবে না। সে হিসাবে বেশি রিজার্ভ ধরে রাখা ‘বোকামি’ ছাড়া আর কিছু নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশের ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফা হয়েছিল ৪ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। এর আগের বছর যা ছিল ৯ হাজার ১২১ কোটি টাকা। অর্থাত্ এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতে নিট মুনাফা কমেছে ৪ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা বা ৫১ শতাংশ। একই ধারা দেখা যাচ্ছে চলতি বছরও। এ বছরের প্রথম ছয় মাসের হিসাব অনুযায়ী অধিকাংশ ব্যাংকের মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় অনেক কমেছে।
২০১২ সালে ব্যাংকগুলোর প্রতি ১০০ টাকা সম্পদের বিপরীতে আয় হয়েছে মাত্র ৬০ পয়সা। আগের বছর যা ছিল ১ টাকা ৩০ পয়সা। অর্থাত্ এক বছরের ব্যবধানে আয় অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। আর ১০০ টাকা ইক্যুইটির বিপরীতে আয় দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭ টাকা ৮০ পয়সা। আগের বছর যা ছিল ১৪ টাকা ৩০ পয়সা। অর্থাত্ এক বছরের ব্যবধানে ইক্যুইটির বিপরীতে আয় কমেছে সাড়ে ৬ টাকা।
আর যেসব ব্যবসায়ী ঋণ নিয়েছেন, তাদের ব্যবসায়-বাণিজ্যের মন্দা ও সঠিক সময়ে উত্পাদনে যেতে না পারার কারণে ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। আর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় আয় থেকে অর্থ এনে বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। এতে ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা কমে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে সামনে ব্যাংকিং খাতের জন্য আর্থিক দুর্যোগ অপেক্ষা করছে।
ব্যাংকের এ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন মালিক-কর্মকর্তারাও। গত ৭ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ব্যাংক সুদ হার ও চার্জ বিষয়ক সেমিনারে এমনই আভাস দেন শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি এ. কে. আজাদ এবং ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সভাপতি ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। তারা বলেন, ব্যাংকগুলোর হাতে এখন প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি নগদ অর্থ রয়েছে। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় তা বিনিয়োগ সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্যাংকগুলোকে ভবিষ্যতে খারাপ পরিস্থিতি পার করতে হতে পারে বলে তারা উল্লেখ করেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশ এখন চরম অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরাও এ অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। ফলে এর প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। বিনিয়োগ না হওয়ায় ব্যাংকে নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়েই চলেছে।
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা না কাটলে ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়ে ব্যবসা করবেন না। অর্থনীতি বাঁচাতে হলে এখন প্রয়োজন সে অনিশ্চয়তা কাটিয়ে ওঠা, যার লক্ষণ খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, ব্যাংকগুলোর উল্লেখযোগ্য আয় না হলেও আমানতকারীকে ঠিকই সুদ দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় বাড়ছে। অস্থিতিশীল অবস্থায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থাও ভালো নয়। অনেক প্রতিষ্ঠান ঠিক সময়ে ব্যাংক ঋণের কিস্তি শোধ করতে পারছে না। আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক অবস্থাকে অজুহাত হিসেবে দেখাচ্ছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং খাতের অবস্থা বেশ নাজুক।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2013/10/23/221630#.UmdGnVMrfDk