থমকে আছে জ্বালানি খাত

দেশে জ্বালানির চাহিদা ক্রমাগতভাবে বেড়ে চললেও দেশীয় জ্বালানিসম্পদ উন্নয়নের কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে। দেশীয় প্রধান বাণিজ্যিক জ্বালানিসম্পদ গ্যাস খাতের পাশাপাশি আরেকটি সম্ভাবনাময় বাণিজ্যিক জ্বালানিসম্পদ কয়লার উন্নয়নেও কার্যকর কোনো অগ্রগতি নেই।

 

 

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, এই স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার প্রক্রিয়া নিয়ে সরকারের মধ্যে তীব্র মতভেদ রয়েছে। এই স্থবিরতা কাটাতে রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্সের পাশাপাশি বিদেশি কোম্পানির সহায়তা যে দরকার হবে, মতভেদ সে বিষয়ে নয়; মতভেদ হচ্ছে, কোন কোম্পানিকে কাজ দেওয়া হবে তা নিয়ে।

মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলার সূত্র জানায়, প্রায় আড়াই বছর আগে ২০১৪ সালের ১৪ জুন ঢাকার পার্শ্ববর্তী রূপগঞ্জে ছোট্ট একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছিল। এরপর দেশে আর কোনো নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়নি। কারণ, আবিষ্কারের তেমন কোনো উদ্যোগই ছিল না, এখনো নেই। বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে কিছু নতুন কূপ খনন করে যেটুকু উত্তোলন বাড়ছে, চাহিদার তুলনায় তা মোটেই উল্লেখযোগ্য নয়।

বিদ্যমান ক্ষেত্রগুলো থেকে দ্রুত উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বাপেক্সের পাশাপাশি রাশিয়ার কোম্পানি গ্যাজপ্রমকে ১০টি কূপ খননের কাজ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাপেক্সের নির্ধারণ করে দেওয়া স্থানে, বাপেক্সেরই করা নকশা অনুযায়ী এসব কূপ খননে তেমন কোনো সুফল আসেনি। এই ১০টি কূপ খননের পর দৈনিক গ্যাস উত্তোলন বেড়েছিল প্রায় ২৩ কোটি ঘনফুট। ইতিমধ্যে এর চারটি কূপ বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যগুলো থেকে মোট উত্তোলনের পরিমাণ ৮ কোটি ঘনফুটেরও নিচে নেমে এসেছে। পরে গ্যাজপ্রমকে আরও পাঁচটি কূপ খননের কাজ দেওয়া হয়।

ইতিমধ্যে চীনের কোম্পানি সিনোপেকও কূপ খননের কাজে ঢুকে পড়েছে। কয়েকটি কূপ খনন করেও ফেলেছে তারা। এই পর্যায়ে গ্যাজপ্রমকে দিয়ে কাজ করানোর বিষয়ে সরকারের মধ্যে তীব্র মতভেদ দেখা দিয়েছে। এর একটি মত গ্যাজপ্রমকে দিয়ে কূপ খনন ছাড়াও বাপেক্সের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে অনুসন্ধানসহ গ্যাস খাতের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করানোর পক্ষে। অপর মতটি এর বিপক্ষে। তারা গ্যাজপ্রম ও সিনোপেকের কাজে প্রধানত ব্যয়ের তারতম্যের বিষয়টি তুলে ধরছে। তবে দুটি মতই প্রবল হওয়ায় সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের হস্তক্ষেপ ছাড়া এই মতভেদ নিরসন সম্ভব হবে না বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন। আর এর নিরসন না হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে জ্বালানি খাত।

দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় নিবিড়ভাবে গ্যাস অনুসন্ধানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের কথা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কয়েক বছর ধরে চলেছে। তারই একপর্যায়ে গ্যাজপ্রম বাপেক্সের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ গড়ার জন্য গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সমঝোতা স্মারকের একটি খসড়া পেট্রোবাংলায় পাঠায়। এর দুই মাস পর পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান একটি চিঠি লিখে গ্যাজপ্রমকে জানান যে খসড়াটি তাঁদের বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে দেখছেন। তারপর এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। অথচ গ্যাজপ্রম এখানে এসেছে বাংলাদেশ ও রাশিয়া সরকারের শীর্ষপর্যায়ের সমঝোতার মাধ্যমে।

ইতিমধ্যে বাপেক্স জ্বালানি খাতে সরকারের ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পাঁচ বছরের একটি সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়েছে। এই পরিকল্পনায় ২০২১ সালের মধ্যে ১১০টি (৫৫টি অনুসন্ধান, ৩২টি উন্নয়ন ও ২৩টি সংস্কার বা ওয়ার্কওভার) কূপ খনন ও তিন হাজার লাইন কিলোমিটার এলাকায় দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ চালানোর কথা বলা হয়েছে। এই পরিকল্পনা থেকে দুই বছরে বাস্তবায়নের একটি কার্যক্রম চূড়ান্ত করা হয়েছে। তাতে ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে ২৮টি কূপ খনন (২২টি অনুসন্ধান, ৩টি উন্নয়ন, ৩টি সংস্কার) ও তিন হাজার লাইন কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ করার কথা বলা হয়েছে। এই ২৮টি কূপের মধ্যে ১৩টি করানো হবে কোনো বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে। আর ১৫টি বাপেক্স নিজেই করবে। অবশ্য এ কাজে বাপেক্সের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কেননা, গত পাঁচ বছরে বাপেক্স ১৫টি কূপ খনন ও ১৫টি সংস্কার করেছে। তা ছাড়া গত জুলাই থেকে কাগজে-কলমে এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু হলেও এখন পর্যন্ত কিছুই দৃশ্যমান নয়।

সমুদ্রবক্ষে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানও বলতে গেলে শুরুই হয়নি। সমুদ্র বিজয়ের পর দেশের সমগ্র সমুদ্র অঞ্চলে ‘মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে’ নামে যে জরিপ চালিয়ে তেল-গ্যাস পাওয়ার প্রাথমিক সম্ভাবনা নিরূপণের উদ্যোগ সরকার নিয়েছিল, তা-ও এখন পর্যন্ত শুরু করা যায়নি। কোন কোম্পানিকে এ কাজ দেওয়া হবে, এখনো সেই জটিলতার পুরোপুরি নিরসন হয়নি।

অবশ্য কয়েক দিন আগে ভারতের ওএনজিসি সমুদ্রবক্ষের দুটি ব্লকে প্রাথমিক জরিপের কাজ শুরু করেছে। অস্ট্রেলীয় কোম্পানি স্যান্তোস ও সিঙ্গাপুরের ক্রিস এনার্জি আরেকটি ক্ষেত্রে অনুসন্ধান শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। তবে এসব উদ্যোগ থেকে ফল পেতে অন্তত তিন বছর লাগবে।

দেশের কয়লাক্ষেত্রের উন্নয়ন বলতেও এখন পর্যন্ত সেই ‘সবেধন নীলমণি’ বড়পুকুরিয়া, যে খনি থেকে উৎপাদিত কয়লা দিয়ে বড় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোও সম্ভব নয়। নতুন কোনো কয়লাক্ষেত্র উন্নয়নের কার্যকর উদ্যোগও নেই।

এ অবস্থায় দেশে জ্বালানির ঘাটতি বাড়ছে। চাহিদা বাড়ছে জ্বালানি তেল, কয়লা প্রভৃতির। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার যে পরিকল্পনা করছে, তাতে কয়েক বছরের মধ্যে জ্বালানি খাত আমিদানিনির্ভর হয়ে পড়বে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, বর্তমানে ব্যবহৃত বাণিজ্যিক জ্বালানির ৭৫ শতাংশ দেশের। ২৫ শতাংশ আমদানি করা হয়। স্থবিরতার কারণে চিত্র ক্রমেই বদলে যাচ্ছে। সরকার যে পরিকল্পনা করছে, তাতে ২০৩০ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি চাহিদার ৭৫ শতাংশ আমদানি করতে হবে। ২৫ শতাংশ ব্যবহৃত হবে দেশীয় জ্বালানি।

বর্তমানে বাণিজ্যিক জ্বালানির মধ্যে আমদানি করা হয় শুধু তেল। এর পরিমাণ বার্ষিক জ্বালানি ব্যবহারের এক-চতুর্থাংশ বা ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা সরাসরি জ্বালানি হিসেবে আর তেমন কিছুই আমদানি করা হয় না।

সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের (সংশোধিত মহাপরিকল্পনা) জন্য কয়লা, ৪ হাজার মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ইউরেনিয়াম, দৈনিক ৩৫০ কোটি (৩৫০০ মিলিয়ন) ঘনফুট গ্যাসের সমপরিমাণ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করা হবে। ২০১৮ সালে দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট দিয়ে আমদানি শুরু হবে উচ্চমূল্যের এই জ্বালানির।

সর্বোপরি প্রতিবেশী দেশসমূহ থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা করছে সরকার। আমদানি কম হলে এই বিদ্যুৎ দেশে উৎপাদনের জন্য আরও জ্বালানি আমদানির প্রয়োজন হবে।

এভাবে জ্বালানি আমদানির পরিমাণ বর্তমানের ২৫ শতাংশ থেকে বাড়তে বাড়তে ২০৩০ সালে ৭৫ শতাংশে উন্নীত হবে। এই জ্বালানি আমদানির জন্য কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হবে, সেই হিসাব এখনো করা হয়নি। কারণ, কয়লা ও এলএনজির উৎসও এখনো চূড়ান্ত নয়।

এদিকে গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বর্তমান ঘাটতি দৈনিক গড়ে প্রায় ৮০ কোটি ঘনফুট। চাহিদা ৩৫০ কোটি। সরবরাহ ২৭০ কোটি ঘনফুট। ২০০৯ সালে এই ঘাটতি ছিল ৫০ কোটি ঘনফুট। তারপর গত ছয়-সাত বছরে গ্যাসের উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে চাহিদাও। আর সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রের উৎপাদন কমেছেও।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ম. তামিম বলেন, দেশের জ্বালানি সম্পদের ব্যবহার বাড়াতে না পারলে জ্বালানি ঘাটতি মিটবে না। কম দামে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহও অসম্ভব হবে। তাই গ্যাসের অনুসন্ধান বাড়াতে হবে। নিজস্ব কয়লা ব্যবহারেরও পদক্ষেপ নিতে হবে।

তথ্যসূত্র : প্রথমআলো

About Author

Profile Picture

Md. Jahangir Alam

Leave a Comment